হিন্দু ধর্মে একতার অভাব কেন ?

অখন্ড ভারতের খন্ডতা দেখেলেই সহজে বোঝা যায় যে, একতার যে শক্তি তা তেমন দৃঢ় ছিল না। বহু বিদেশীই ভারতবর্ষকে আক্রমন করেছে এবং অনেকে অনেক দিন শাসনও করেছে। কিন্তু বিশেষ করে মুসলিম শাসন আমলে ভারতবর্ষকে আক্রমন করে যেভাবে হিন্দু ধর্মীয় বিষয় বস্তুর উপর তাদের ধ্বংস লীলা চালিয়েছে এবং দেশ শাসনের সময় সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে হিন্দুদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে তখনও হিন্দু সমাজে তেমন একতার কোন বিশেষ কার্য চোখে পরে নাই। হয়তো বা দু-একটি কার্য-ক্রম হয়েছে তা যে একতার বিশাল বলশালী প্রতিরোধ তা বলা যায় না। ইংরেজ বা খৃষ্টান শাসনের সময়ও তেমন কিছু একত্রিত প্রতিবাদ গড়ে উঠতে দেখা যায় না। এমন কী বর্তমান কোথাও কোথাও অপর বিশেষ ধর্মের তান্ডবেও ভারতীয় হিন্দুদেরকে একত্রিত হয়ে প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ তেমন করতে দেখা যায়নি। এর বিশেষ কারণ কী ? আমরা কিছু কারণ খুঁজবার চেষ্টা করছি।

প্রথম কারণ: (ধরমীয়) –

হিন্দু ধর্ম সৃষ্টির পর থেকে প্রাকৃতিক ভাবে মানবিক বিকাশের সাথে সাথে উন্নতি লাভ করেছে। সুতরাং এই ধর্ম বহু মহাপুরুষদের অভিজ্ঞতা ও তাদের বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্তে আজ এই ধর্ম এমন রূপ লাভ করেছে। তাই মানুষ সর্ব্বোচ্চ সত্যকে জেনেছেন যে, আমিই সেই সত্ত্বা যে এই জগতের বিষয় বাসনার সাথে আমার ইন্দ্রিয়জ সংযোগে সংসারে ভোগে সব ভুলে গেছি। তাই শান্ত ও নির্জনে থেকে অন্তরমুখী হয়ে নিজের স্বরূপে ফিরে যাওয়া। আমি যা সেই রূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়াই আমাদের ধর্ম এর মূল সাধনা। এবং এটিই পরম সত্য। সুতরাং আমাদের আধ্যাত্মিকতার কোর বিষয় হচ্ছে সবার সাথে সংগ নয় বরং একাকী নির্জনে থাকা। এর ফলে সংঘ শক্তি কখনো গড়ে ওঠে নাই। বরং কখনো কখনো সাধনার নাম করে গুরুবাদকে ভিত্তি করে একই গুরুর শিষ্যদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার চেষ্টা দেখা যায় যা হিন্দু ধরমেকে আরও বিচ্ছিন্ন করেছে।

কিন্তু অপর পক্ষে আর অন্যান্য সমস্ত ধর্ম কোন না কোন ধর্মকে কাউন্টার করে সৃজন হয়েছে। যেমন বৌদ্ধ ধর্ম হিন্দু ধর্ম কে প্রতিবাদ করে জন্ম নিয়েছে। তাই হিন্দুদের কে কাউন্টার করতে তারা বৌদ্ধ সংঘ নির্মানের প্রয়োজন বোধ করেছেন। তারা মানবের মূলে যাবার চেয়ে হিন্দুদেরকে কাউন্টার করাই বেশী গুরুত্ব দিয়েছে।

ইসলাম ধর্মও মূরতী পূজার বিরোধিতা করে সৃষ্টি হয়েছে এবং সেই যুগের যারা এই মুরতি পুজা করতো তাদেরকে কাফের বা যা তাদের ভাষা তা ঘোষনা দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন। সুতরাং মানব মনের বিকাশ ও তার সর্বচ্চ অবস্থায় পৌছানোর চেয়ে কাফেরদের প্রতিহত করতে সংঘ নিরমান করাই বেশী প্রয়োজন দেখা দিয়েছে, তাই তারা হিন্দুদের চেয়ে বেশী একতা যুক্ত। এভাবেই খৃষ্টান, ইহুদিদের বিরুদ্ধ আচরণ করে, আরও অন্যান যারা আছে অনেকটাই এভাবে।

দ্বিতীয়ত কারণ, ( সাম্রাজ্যবাদ )-

পৃথিবীর সকল ধরমকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদ বা নতুন নতুন দেশ দখল করে ধরমো ভিত্তিক ভাবে গড়ে তুলেছেন। ফলে তারা অনেক বেশী ঐক্য বদ্ধ। কিন্তু হিন্দু ধরমকে নিয়ে কখনোই এমন কোন প্রচষ্টা গড়ে ওঠে নাই এবং হিন্দু ধরমটাই ওভাবে বিস্তার হয় নাই। তাই অন্যান ধরমের চেয়ে হিন্দুরা কম ঐক্যবদ্ধ। তাই খৃষ্টানদের প্রায় একশোরও বেশী দেশ আর মুসলমানদের ৫৭ টি দেশ নির্মাণ করেছে। বৌদ্ধরাও কিছু দেশ আজও তাদের মতো করে চালাচ্ছে। কিন্তু প্রায় দেড়শ কোটি হিন্দু থাকার পরও কোন হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে ওঠে নাই।

তৃতীয় কারণ: ( সামাজিক )-

হিন্দু ধরমে যে বর্ণভেদ প্রথা তা সমাজকে সুষ্ঠু ভাবে চালানোর জন্য করা হয়েছিল। কিন্তু এর অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার তা বৈষম্যর দিকে নিয়ে গেছে ফলে আমাদের একতার মধ্যে বিভাজন দেখা দিয়েছে। সকল মুসলমানগন নিজেদের স্বার্থ এ তা ব্যবহার করতে সমাজে ভুল ভাবে তার ব্যাখ্যা করে প্রচার করেছেন। খৃষ্টানরাও তাই হিন্দুদেরকে নীচু দেখানোর জন্য এক সমাজ ব্যবস্থাকে বৈষম্যমূলক ভাবে ব্যাখ্যা করে হিন্দুদের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে তারা দেশ শাসন করে গেছেন। এখানে মনে রাখার বিষয় তারা আমাদের মঙ্গলের জন্য এসব করে নাই তাদের স্বারথে করেছে। তারা আমাদেরকে এভাবে ভেঙ্গে দিয়ে শাসন, শোষন ও নিরযাতন করেছেন। যাক সে কথা আমাদেরকে এই প্রথা নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে হবে।

চতুরথ কারণ: ( সংষ্কৃতি বিষয়ক ) –

আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশ বিস্তৃর্ন এলাকা জুরে বিদ্যমান ছিল। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই এক প্রান্তের লোক-জনদের সাথে অপর প্রান্তের লোক-জনদের সংষ্কৃতি কখনোই এক হবে না। বিধরমীরা এই বৈচিত্রময়তাকে ঐক্যহীন দেখিয়ে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। বৈচিত্রময়তা যে কোন দেশের জন্য সৌন্দরয্ তা আমরা ভুলে গেছি। প্রকৃত পক্ষে আমরা হিন্দুরা নিজেদের ধরমীয় গুরুদের থেকে ধরম্ না শিখে বিধরমী জাকির নায়েকের কাছ থেকে ধরম্ শুনি আর ওরা আমাদেরকে সহজেই বিভ্রান্ত করে ফেলে।

পঞ্চম কারণ: ( রাজনৈতিক ) –

হিন্দুদের অনৈক্যর পিছনে এই কারণই সবচেয়ে বড়। পৃথিবীতে আর কোন দেশ আছে কিনা আমার জানা নেই যে, বৃহৎ ধরমো গোষ্টির বিরোধীতা করে রাজনীতি করা যায়। এটি হিন্দুদের রাজ্যেই সম্ভব। হিন্দুরা নিজেদের ধরমের অপমান দেখতে ও শুনতে খু্বিই পছন্দ করে। তাইতো হিন্দু ধরম্ কে বিরোধীতা করে অনেক দল গড়ে উঠেছে এবং তারা এক দীরঘো সময় দেশ শাসন করে মানুষকে ধরমো বিরোধী করে তুলেছে। তারা ধরমো নিরপেক্ষতার নাম করে হিন্দু ধরমোকে সমাপ্ত করতে চেয়েছে আর অন্য ধরমো কে প্রচার ও প্রসার করেছে। রাজনৈতিক হীন স্বারথো চরিথারথো করবার জন্য তারা হিন্দুদেরকে ধরমান্তরিত পর্যন্ত করায়। শুধু কোন একক দল নয় এক পুরো ইকো সিষ্টেম কাজ করছে। বোকা হিন্দুরা তা বুঝতেও পারেনা এবং বোঝার চেষ্টাও করে না। কারন হিন্দুরা ধারমীক নয়, পেট ভরানোবাদী। কোন হিন্দুকে দশ টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে তার সামনেই তার ধরমোকে গাল দিতে কারোর কোন অসুবিধা হয় না। কারণ অপর জন জানে লোভী হিন্দু দশ টাকা পেয়েছে ও আর কিছু বলার ক্ষমাতয় নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হিন্দু নেতারাই হিন্দুদেরকে নিরযাতন করে ঘরে আটকে রেখে সামান্য কয়েক পারসেন্ট লোককে হাতে নিয়ে নিজের রাজনৈতিক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বোক সাধারন হিন্দুরা এই অবস্থা দেখে কষ্টও অনুভব করে না কিংবা এখান থেকে বের হবার পথও খোজে না। তারা এটা তাদের নিয়তি মেনে নিয়েছে।

এসকল কারণ ছাড়াও আরও অনেক ছোট ছোট কারণ বিদ্যমান যা হিন্দুদের কে কখনোই ঐক্য মতে পৌছাতে দেয় নাই। আমাদেরকে আরও সচেতন হতে হবে তবেই রক্ষা পাবো নচেৎ নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top